Admission
পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ২য় পত্র - মহাবিশ্বের মূল বস্তু ও ঘটনা

   মহাবিশ্বের মৌলিক উপাদান তিনটি হলো। 

(ক) সৌরজগৎ (Solar Stystem) (খ) নক্ষত্ৰসমূহ (Stars) (গ) গ্যালাক্সিসমূহ (Galaxies )

  (ক) সৌরজগৎ (Solar System) : সূর্য ও এর গ্রহ ও উপগ্রহ, ধূমকেতু, উল্কা, গ্রহাণু, গ্যাস, ধূলিকণা ইত্যাদি নিয়ে সৌরজগৎ গঠিত। সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্র। সূর্যকে কেন্দ্র করে এর আটটি গ্রহ ঘুরছে। এই আটটি গ্রহ হলো বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন। সকল গ্রহই সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার (elliptical) পথে ঘুরছে। কিছু গ্রহের রয়েছে উপগ্রহ। এগুলো গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বুধ ও শুক্রের কোনো উপগ্রহ নেই ।

চিত্র :১১.২

   পৃথিবীর রয়েছে একটি, মঙ্গল ও নেপচুনের প্রত্যেকের দুটি, ইউরেনাসের পাঁচটি, শনির দশটি এবং বৃহস্পতির রয়েছে ১২টি উপগ্রহ। এসব উপগ্রহকে গ্রহের চাঁদ বলা হয়। সৌরজগতে একমাত্র সূর্যেরই আলো আছে, অন্য কোনোটির নেই। সূর্যের আলো পড়ে সৌরজগতের গ্রহ ও উপগ্রহ আলোকিত হয়। এছাড়া সৌরজগতে রয়েছে অনিয়মিত আকারের হাজার হাজার বস্তু। এরা হলো উল্কা, ধূমকেতু, গ্রহাণু, গ্যাস, ধূলিকণা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কঠিন বস্তু ইত্যাদি।

   (i) সূর্য (The Sun) : 

   সূর্য গ্যাসীয় পদার্থ দ্বারা তৈরি একটি অতিমাত্রায় গরম ও উজ্জ্বল বস্তু। এটি সৌরজগতের পীতবর্ণ সম্পন্ন নক্ষত্র এবং পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্র। তাই একে অন্য নক্ষত্রের তুলনায় বেশি উজ্জ্বল দেখায় । পৃথিবী থেকে সূর্য আট আলোক মিনিট দূরে। সূর্য হতে পৃথিবীতে আলো আসতে ৮ মিনিট সময় লাগে। এর পৃষ্ঠ তাপমাত্রা 6000 K । এর ভর 1.99 × 10-30 kg । গড় ব্যাসার্ধ 6.95 x 108m। সূর্য পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে 1.496 x 1011 m দূরত্বে অবস্থিত। এর ঘনত্ব 1410 kgm-3 যা পানির তুলনায় প্রায় 1.4 গুণ। সূর্য তার নিজ অক্ষের উপর 25 দিনে একবার ঘুরে আসে। সূর্যের পৃষ্ঠে তার আকর্ষণের জন্য ত্বরণের মান 275 ms-2 হিসাব করা হয়েছে। এটি রেডিও বা বেতার অঞ্চলে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ নিঃসরণ করে।

  (ii) গ্রহ ( The Planets) : 

আমরা জানি যে সকল নিরেট খ-গোলীয় বস্তু সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে তাদেরকে গ্রহ বলা হয়। গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে উপবৃত্তাকার পথে ভ্রমণ করে। তাদের নিজস্ব কোনো আলো নেই । কিছু গ্রহকে কেন্দ্র করে আবর্তনশীল উপগ্রহ আছে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ হচ্ছে চন্দ্র। এটি পৃথিবীকে কেন্দ্ৰ করে ঘুরে। বুধ ও শুক্র গ্রহের কোনো উপগ্রহ নেই। মঙ্গল এবং নেপচুন গ্রহের দুটি করে উপগ্রহ আছে। শনি গ্রহের দশটি এবং বৃহস্পতি গ্রহের বারোটি উপগ্রহ আছে। উপগ্রহগুলোকে গ্রহের চন্দ্র বলা হয়। 

    (iii) গ্রহাণুপুঞ্জ (Asteroids) : 

   মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথের মাঝ দিয়ে অতিক্ষুদ্র গ্রহের মতো কিছু বস্তু সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে; তাদের বলা হয় গ্রহাণু। গ্রহাণু আবিষ্কারের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় 2000 গ্রহাণুপুঞ্জ আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের সর্ববৃহৎটির নাম সেরেস। এর ব্যাসার্ধ 350 km এবং সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় 4.6 বছর। ক্ষুদ্রতমটির ব্যাসার্ধ 50m

চিত্র : ১১.৩

    (iv) ধূমকেতু (Comet) : 

   পানি, এমোনিয়া ও মিথেন গ্যাস কোনো নিরেট ক্ষুদ্র শিলাখণ্ডের উপর জমে তৈরি হয় ধূমকেতু। এর একটি মাথা ও লেজ আছে বলে মনে হয়। সূর্যকে কেন্দ্র করে উপবৃত্তাকার পথে ঘোরার সময় এর সামনের দিকের পানি বাষ্পে পরিণত হয় এবং বিকিরণ চাপে এর সামনের দিকে স্ফীত (একটি মাথা) ও পিছনের দিকে সরু লেজের মতো হয়ে যায়। দেখতে অনেকটা ঝাড়ুর মতো দেখায়। এদের মধ্যে হেলির ধূমকেতু বিখ্যাত । এটা ৭৬ বছর পরপর একবার দেখা যায়। ধূমকেতুর মাথাটা শিলার মতো ভারী বস্তু এবং পুচ্ছ বা লেজের দিকটি হালকা পদার্থ যেমন ধূলিকণা ও গ্যাস দিয়ে তৈরি।

   (v) উল্কা ( Meteors) : 

   অনেক সময় আকাশে ছোট আগুনের গোলা ছুটে যেতে দেখা যায়। মনে হয় যেন একটি তারা একস্থান থেকে ছুটে অন্যস্থানে যাচ্ছে। এরা আসলে নক্ষত্র বা তারা নয়। এদের বলা হয় উল্কা। অতিক্ষুদ্র গ্রহগত শিলা খণ্ড যখন পৃথিবীর কাছাকাছি এসে গেলে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের প্রভাবে প্রবল বেগে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে বায়ুর সাথে ঘর্ষণের ফলে উত্তপ্ত হয়ে জ্বলে ওঠে এবং পৃথিবী পৃষ্ঠের পতনের পূর্বেই নিভে যায়। এদের উল্কা বলে।

   

চিত্র :১১.৪

 (খ) নক্ষত্রসমূহ (Stars) : 

    যেসব খ- পদার্থ সূর্যের ন্যায় নিজস্ব আলো আছে এবং তা আলো দেয় তাদের বলা হয় নক্ষত্র। পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্র হলো সূর্য। সৌরজগতের বাইরে অনেক দূরে দূরে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র রয়েছে। এদেরকে ক্ষুদ্র ও মিটমিট করে জ্বলতে দেখা যায় এর কারণ এরা পৃথিবীর অনেক অনেক দূরে। সূর্যের পর নিকটতম নক্ষত্র হলো আলফা সেন্টুরি । পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব চার আলোক বর্ষ।

চিত্র :১১.৫

    (গ) গ্যালাক্সি (Galaxies) : 

   অনেকগুলো নক্ষত্রের সমাবেশকে বলা হয় গ্যালাক্সি। আমরা যে গ্যালাক্সিতে বা ছায়াপথে বাস করি তার নাম আকাশ গঙ্গা (Milky way)। সূর্য ও খালি চোখে দৃশ্যমান সকল নক্ষত্র এই আকাশ গঙ্গা বা ছায়াপথে রয়েছে। এ ছায়াপথে প্রায় 10 সংখ্যক নক্ষত্র রয়েছে। এই ছায়াপথ ছাড়াও মহাবিশ্বে রয়েছে লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সি। এদের খালি চোখে দেখা যায় না। এসব গ্যালাক্সির আকার ও আয়তন বিভিন্ন। কোনোটা উপবৃত্তাকার, কোনোটা সৰ্পিল । সবচেয়ে উজ্জ্বল কিছু কিছু গ্যালাক্সি উপবৃত্তাকার। অ্যানড্রোমেড়া একটি গ্যালাক্সি যাকে খালি চোখে দেখা যায় না। আমাদের গ্যালাক্সি (ছায়াপথ) থেকে এর দূরত্ব 2 x 10° আলোকবর্ষ। সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়েও অনেক গ্যালাক্সি দৃষ্টিগোচর হয় না।

গ্যালাক্সি প্রধানত দু প্রকার ।

(ক) স্বাভাবিক গ্যালাক্সি (খ) রেডিও গ্যালাক্সি

 

(ক) স্বাভাবিক গ্যালাক্সি (Normal Galaxies) : 

আমরা জানি যে, গ্যালাক্সি হলো মহাবিশ্বের মৌলিক উপাদান। আমাদের ছায়াপথ ছাড়াও মহাবিশ্বে লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সি রয়েছে। এদের বলা হয় স্বাভাবিক গ্যালাক্সি। স্বাভাবিক গ্যালাক্সি তিন প্রকার হয় -

(i) উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি 

(ii) সর্পিল বা পেঁচানো গ্যালাক্সি 

(iii) বিষম গ্যালাক্সি। - 

   (i) উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি : যে সব গ্যালাক্সি দেখতে উপবৃত্তাকার চাকতির মতো তাদের বলা হয় উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি। এগুলো সাধারণত লোহিত দানব ও শ্বেত বামন নক্ষত্র নিয়ে গঠিত। গ্যালাক্সির শতকরা ১৮ ভাগ উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি। 

  (ii) সর্পিল বা পেঁচানো গ্যালাক্সি : অধিকাংশ স্বাভাবিক গ্যালাক্সি (প্রায় ৮০%) হলো পেঁচানো গ্যালাক্সি। আমাদের ছায়াপথ (Milky way) ও অ্যানড্রোমেডা এই ধরনের গ্যালাক্সি ।

  (iii) বিষম গ্যালাক্সি : এ ধরনের গ্যালাক্সির কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই। কনিষ্ঠ স্বাভাবিক গ্যালাক্সি হলো বিষম গ্যালাক্সি। এরা মধ্যবয়সী। স্বাভাবিক গ্যালাক্সি শতকরা ২ ভাগ বিষম গ্যালাক্সি।

   

চিত্র :১১.৬

   (খ) রেডিও গ্যালাক্সি ( Radio galaxies) : 

   যেসব গ্যালাক্সি রেডিও কম্পাঙ্কের তাড়িত চৌম্বক বিকিরণ নিঃসরণ করে তাদের রেডিও গ্যালাক্সি বলে। রেডিও গ্যালাক্সিকে দু ভাগে ভাগ করা যায়।

 (i) সাধারণ রেডিও গ্যালাক্সি 

 (ii) কোয়াসার। 

(i) সাধারণ রেডিও গ্যালাক্সি যে স্বাভাবিক আলোকীয় গ্যালাক্সির দুই পাশে দুটি প্রবল রেডিও উৎস রয়েছে, এদের সাধারণ রেডিও গ্যালাক্সি বলে। এটা দেখতে অনেকটা কোনো ব্যক্তির মুখমণ্ডলের দুই পাশে দুটি কানের মতো। রেডিও ক্ষমতা উৎপাদের (output) পাল্লা হলো 1030 থেকে 1038 ওয়াট।

(ii) কোয়াসার (Quasar) : কোয়াসার হলো আধা নাক্ষত্রিক (Quasi-stellar) রেডিও উৎস। এদের গঠন নক্ষত্রের ন্যায় এবং এরা ক্ষমতাশালী বেতার তরঙ্গ নিঃসরণ করে। এদের রেডিও উৎপাদ 1037 থেকে 1038 ওয়াট পাল্লার মধ্যে। কোয়াসার হলো দূরবর্তী জ্ঞাত বস্তু । এরা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। এরা যেন মহাবিশ্বের সীমানায় রয়েছে। এরা পৃথিবী থেকে 0.9C বেগে সরে যাচ্ছে। এদের আকার খুব ছোট। এরা অতি ঘন গ্যালাক্সি গঠন করে। এদের ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি এবং এদের মহাকর্ষ বলও অনেক বেশি। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি কোয়াসার শনাক্ত করা গেছে। 

মহাবিশ্বের ঘটনা

  মহাবিশ্বে ঘটছে নানান ঘটনা। নক্ষত্রের হাইড্রোজেনের পরিমাণ কমে তৈরি হচ্ছে সুপারনোভা এবং তার বিস্ফোরণ ঘটে তৈরি হচ্ছে পালসার। বিভিন্ন নক্ষত্রে ঘটছে নানান রকম নিউক্লিয় প্রতিক্রিয়া। ঘটছে নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যুর মতো ঘটনা, তৈরি হচ্ছে কৃষ্ণ গহ্বর।

এছাড়া সৌরজগতে ঘটছে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ, উল্কাপাত ইত্যাদি। আমরা এখানে সূর্যের শক্তির উৎস, নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু, পালসার সৃষ্টি ইত্যাদি ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব।

 সূর্যের শক্তির উৎস : 

এটা দেখা গেছে যে, সূর্য প্রতি সেকেন্ডে 4 x 1026 জুল শক্তি বিকিরণ করে। সূর্য এই বিপুল পরিমাণ শক্তি কোথা থেকে পায়? এই শক্তি সূর্য পায় নিউক্লিয়ার ফিউশান বিক্রিয়া থেকে। সূর্যের ভিতর অতি উচ্চ তাপমাত্রার কারণে চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস ফিউশানিত হয়ে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এই যে বিক্রিয়া যাতে হালকা নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে ভারী নিউক্লিয়াস তৈরি করে তাকে বলা হয় ফিউশন। ফিউশন বিক্রিয়াকে নিম্নোক্তভাবে দেখানো যায় :

  4H11H24e+2n10+ শক্তি

     আইনস্টাইনের ভরশক্তি সমীকরণ E = mc2 মোতাবেক এই শক্তির উদ্ভব হয়। এভাবে E হচ্ছে নির্গত শক্তি, হচ্ছে ভরের হ্রাস এবং c হচ্ছে আলোর বেগ । 

    এটা জানা গেছে যে, প্রতিটি ফিউশন বিক্রিয়ায় বিন্দু পরিমাণ ভর হারিয়ে যায়। অর্থাৎ যেসব হালকা নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে যে ভারী নিউক্লিয়াস তৈরি করে তার ভর, হালকা নিউক্লিয়াসগুলোর ভরের যোগফলের চেয়ে কম। সুতরাং একত্রিত হওয়ার ফলে কিছু পরিমাণ ভর হারিয়ে যায়। এই হারানো ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এটা দেখানো যায় চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরির জন্য প্রচুর শক্তি নির্গত হয়। সূর্যে রয়েছে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, সূর্য আরও কোটি কোটি বছর আমাদের আলো ও তাপ দেবে।

  সৌর ঔজ্জ্বল্য : 

  সূর্য থেকে প্রতি সেকেন্ডে চতুর্দিকে নির্গত শক্তির পরিমাণকে সৌর ঔজ্জ্বল্য বলে। একে Ls দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

  Ls = 4πR2 × S...  (11.1)

   এখানে, S = সৌর ধ্রুবক যার মান 1.38 x 103; R = সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসার্ধ যার মান

1 AU = 1.496 x 1011m |

নিজে কর : সৌর ধ্রুবক 1.38 x 10"; সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর কক্ষপথে ব্যাসার্ধ IAU হলে সৌর ঔজ্জ্বল্য নির্ণয় কর।

 

Content added || updated By

কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণগহ্বর (Black Holes) : 

    কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কিত ধারণাটি সাম্প্রতিক। ১৯৬৯ সালে একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী জন হুইলার কৃষ্ণবিবর শব্দটি সৃষ্টি করলেও চিন্তাধারাটির বয়স বস্তুত দু'শ বছর । ঐ সময় আলো সম্পর্কে দুটি তত্ত্ব প্রচলিত ছিল— একটি হলো তরঙ্গতত্ত্ব, অপরটি কণিকাতত্ত্ব। তরঙ্গতত্ত্ব অনুসারে আলোক তরঙ্গ দিয়ে গঠিত, আর কণিকা তত্ত্ব অনুসারে আলোক কণিকা দিয়ে গঠিত। দুটি তত্ত্বই সঠিক, আসলে আলো তরঙ্গ ও কণিকা দুইই ।

আলো যদি তরঙ্গ হয় তাহলে এর ওপর মহাকর্ষের কী প্রভাব হবে, তরঙ্গরূপী আলো মহাকর্ষ বল দ্বারা আকৃষ্ট হবে কিনা তা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু আলো যদি কণিকা দিয়ে গড়া হয় তাহলে এই কণিকারূপী আলোর ওপর মহাকর্ষের আকর্ষণ বল কাজ করবে না কেন? অবশ্যই আলো মহাকর্ষ দ্বারা প্রভাবিত হবে।

   প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল আলোর দ্রুতি অসীম বলে মহাকর্ষ এর দ্রুতিকে কমিয়ে আলোর গতি মন্থর করতে পারবে না। কিন্তু পরবর্তীতে আলোর দ্রুতি অসীম নয়, এর সীমা আছে এটি আবিষ্কৃত হলো। সুতরাং আলোর ওপর মহাকর্ষের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক।

    কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক জন মিচেল তাঁর এক প্রবন্ধে বলেন যে, একটি তারকায় যদি যথেষ্ট ভর ও ঘনত্ব থাকে, তাহলে তার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এত শক্তিশালী হবে যে, আলোক সেখান থেকে নির্গত হতে পারবে না। সেই তারকার পৃষ্ঠ থেকে নির্গত আলোক বেশি দূর যাওয়ার আগেই তারকাটির মহাকর্ষীয় আকর্ষণ তাকে পিছনে টেনে নিয়ে আসবে। এরকম বহুসংখ্যক তারকা রয়েছে বলে মিচেল ধারণা করেছিলেন। ঐ সব তারকা থেকে আলো আসতে পারে না বলে আমরা এদের দেখতে পাই না। তবে এদের মহাকর্ষ আকর্ষণ আমাদের বোধগম্য হবে, এই সমস্ত বস্তুপিণ্ডকে আমরা কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণগহ্বর বলি। 

   কৃষ্ণবিবরের ধারণাটি আধুনিক মহাকর্ষ তত্ত্বের একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও চমকপ্রদ ফসল। একে মৌলিক নিউটনীয় নীতি থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা আমাদের অতি পরিচিত সূর্যকে নিয়ে শুরু করতে পারি। সূর্যের ভর M = 1.99 × 1030 kg এবং এর ব্যাসার্ধ = 6.96 x 108m। সূর্য অন্যান্য নক্ষত্রের তুলনায় অনেক বড় কিন্তু অন্যান্য নক্ষত্রের মতো সূর্য অতটা ভরযুক্ত নয়। সূর্যের গড় ঘনত্ব হলো—

ρ=MV=M43πR3=1.99×1030kg43×3.14×(6.96×108 m)3=1410 kg m3 

আমরা জানি, পৃথিবীর জন্য কোনো বস্তুর মুক্তি বেগ 11.2 kms-1। সূর্যের জন্য এই মুক্তি বেগ v হলো:

v=2GMR=2GR.43πR3ρv=8Gπρ3.R 

বা, v = 6.18 x 105ms-1.. (11.2)

বা, v = 6.18 x 102 kms-1

এই মুক্তি বেগ ঘণ্টায় 2.2 মিলিয়ন কিলোমিটার বা 22 লক্ষ কিলোমিটারের সমান। এই বেগ আলোর বেগের 1 প্রায় 500 ভাগের এক ভাগ । সমীকরণ (11.2) থেকে দেখা যায় যে, মুক্তি বেগ v  R l

     মুক্তি বেগ সূর্যের গড় ঘনত্ব ও ব্যাসার্ধের ওপর নির্ভর করে। কোনো বস্তুর ঘনত্ব যদি সূর্যের সমান এবং ব্যাসার্ধ যদি সূর্যের 500 গুণ হয়, তাহলে ঐ বস্তুর পৃষ্ঠ থেকে মুক্তি বেগ হবে আলোর দ্রুতি এর চেয়েও বেশি। সুতরাং আলোকে সে নিজের দিকে টেনে রাখবে, ঐ বস্তু থেকে নির্গত আলো বস্তুতেই ফিরে যাবে, বস্তু থেকে বেরুতে পারবে না। এরকম বস্তুর ধারণা প্রথম দেন মিচেল। এ ধরনের বস্তুকে বর্তমানে বলা হয় কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণগহ্বর।

    M ভরের কোনো বস্তু তখনই কৃষ্ণবিবর হিসেবে কাজ করবে যখন এর ব্যাসার্ধ, একটি নির্দিষ্ট সংকট ব্যাসার্ধের সমান বা কম হবে। মুক্তি বেগ v এর সমীকরণে v এর পরিবর্তে c বসালে আমরা এই সংকট ব্যাসার্ধ পেতে পারি। এই সংকট ব্যাসার্ধ বের করার জন্য কার্ল সোয়ার্ডস্কাইল্ড আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করেন। ফলে সমীকরণটি দাঁড়ায়,

c=2GMRs

  এখানে c আলোর দ্রুতি, Rs সংকট ব্যাসার্ধ সংকট ব্যাসার্ধ R, কে সোয়াস্কাইন্ড ব্যাসার্ধও বলা হয়। Rs এর জন্য সমাধান করে আমরা পাই,

Rs=2GMc2...  (11.3)

   M ভরবিশিষ্ট অঘূর্ণনশীল বা ঘূর্ণনবিহীন কোনো গোলকীয় বস্তুর ব্যাসার্ধ যদি Rs, হয় তাহলে কোনো কিছুই (আলোও) এই বস্তুপৃষ্ঠ থেকে মুক্ত হতে পারবে না এবং বস্তুটি কৃষ্ণবিবর হিসেবে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে Rs, ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো বস্তু থাকলে কৃষ্ণবিবরের মহাকর্ষ আকর্ষণ দ্বারা আটকা পড়বে এবং বস্তুটি থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কৃষ্ণবিবরকে ঘিরে Rs, ব্যাসার্ধের গোলকের পৃষ্ঠকে বলা হয় 'ঘটনা দিগন্ত'। কারণ, যেহেতু আলো এই গোলকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, সুতরাং এর ভেতরে সংঘটিত কোনো ঘটনা আমরা দেখতে পাই না। এই ঘটনা দিগন্তের বাইরের কোনো পর্যবেক্ষক শুধু জানতে পারেন এখানে একটি কৃষ্ণবিবর আছে, জানতে পারেন এর ভর (অন্য বস্তুর ওপর এর মহাকর্ষীয় প্রভাব থেকে), এর তড়িৎ আধান (অন্য আহিত বস্তুর ওপর কৃষ্ণবিবর প্রযুক্ত তড়িৎ বল দ্বারা) এবং এর কৌণিক ভরবেগ ।

    কৃষ্ণবিবর কী করে তৈরি হয় সেটা বুঝতে হলে আমাদের তারকার জীবনচক্র বুঝতে হবে। যখন বৃহৎ পরিমাণ বায়ু নিজস্ব মহাকর্ষীয় আকর্ষণের চাপে নিজের উপরেই চুপসে যেতে থাকে তখন একটি তারকা সৃষ্টি হয়। তারকাটি সংকুচিত হবার সাথে বায়ুর পরমাণুগুলো ক্রমশ বেশি ঘন ঘন ও বর্ধনশীল দ্রুতিতে পারস্পরিক সংঘর্ষ হতে থাকে, ফলে বায়ু উত্তপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত এতটা উত্তপ্ত হয় যে প্রবল তাপে হাইড্রোজেন পরমাণু ফিউশনিত হয়ে হিলিয়াম পরমাণুতে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়া একটি নিয়ন্ত্রিত হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের মতো, এর ফলে যে তাপ নির্গত হয় তার জন্যই তারকাটি আলোক বিকিরণ করে।

নক্ষত্রের জন্ম ও জীবনচক্র : 

  শুরুতে নক্ষত্র থাকে আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলিকণা ও গ্যাসের এক বিশাল মেঘ রূপে । মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ধূলিকণা ও গ্যাসের এই বিশাল মেঘ সংকুচিত হয়। সংকোচনের সময় উচ্চ চাপ ও উচ্চ তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে যখন কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি হয়, তখন তাপ-নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সংঘটিত হয়, পরিণামে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। ফলে পদার্থের গোলকটি দীপ্তি ছড়ায়। এই অবস্থা বা ধাপকে বলা হয় নক্ষত্রের জন্ম। নক্ষত্রের বিবর্তনের এটি হলো আদি বা প্রারম্ভিক পর্ব। বামন নক্ষত্র এই ধাপে পাওয়া যায়। মোট নক্ষত্র সংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ হলো এই বামন নক্ষত্র। আমাদের সূর্য বর্তমানে এই ধাপে রয়েছে।

  নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় মূলবস্তুতে বা অন্তর্বস্তুতে যতক্ষণ পর্যন্ত হাইড্রোজেন জ্বালানি থাকে, ততক্ষণ নক্ষত্রে তাপ নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। হাইড্রোজেন নিঃশেষ হয়ে গেলে নক্ষত্রের মূলবস্তু সংকুচিত হতে থাকে কিন্তু বহিস্থ অংশ তখনও প্রসারিত হতে থাকে। ফলে নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং একই সাথে পৃষ্ঠ তাপমাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। নক্ষত্রের বিবর্তনের এই ধাপকে বলা হয় দানব নক্ষত্র বা অতি দানব নক্ষত্র। এসব নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ সূর্যের ব্যাসার্ধের 50 থেকে 220 গুণ পর্যন্ত হয়। এখন থেকে 5 বিলিয়ন (500 কোটি) বছর পরে আমাদের সূর্য এই ধাপে পৌঁছাবে।

   নক্ষত্র বামন ধাপের চেয়ে অনেক কম সময় দানব ধাপে থাকে। প্রায় এক মিলিয়ন বছর পর দানব নক্ষত্র শীতল হতে থাকে ফলে নক্ষত্রটি সংকুচিত হতে থাকে। এর পরে এই নক্ষত্রের কী ঘটবে তা নির্ভর করে এর আদি বা মূল ভরের ওপর। যেসব সম্ভাব্য অবস্থা বা ধাপ ঘটতে পারে তা হলো :

   (ক) নক্ষত্রের ভর যদি দুই সৌর ভরের চেয়ে কম হয় : 

এ রকম অবস্থায় নক্ষত্রটি যখন সংকুচিত হতে থাকে, তখন এর শক্তি মুক্ত হতে থাকে কিন্তু এটি এমন একটি ধাপে বা অবস্থায় পৌঁছায় যে এটি এর বহিস্থ আস্তরণকে উড়িয়ে বা ছুঁড়ে দেয়। ফলে হঠাৎ করেই প্রচুর পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় যা নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে দেয়। এ ধাপে নক্ষত্রটি এত উজ্জ্বল হয় যে, খালি চোখেও দেখা যায়। এটি এখন নোভা স্টার বা নোভা নক্ষত্র অর্থাৎ একটি নতুন নক্ষত্র ।

উপরোক্ত বিস্ফোরণে যা অবশিষ্ট থাকে তাকে বলা হয় শ্বেত বামন নক্ষত্র। নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের জন্য কোন হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম এতে থাকে না। নক্ষত্রটি থাকে অত্যন্ত ঘন বা ভারী। সময়ের সাথে এর ঔজ্জ্বল্য কমতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি দীপ্তি ছড়ায়। 

  (খ) নক্ষত্রের ভর যখন দুই থেকে পাঁচ সৌর ভরের মধ্যে থাকে : 

এ রকম নক্ষত্রের বেলায়, সংকোচনের সময় এমন একটি ধাপে পৌঁছায় যে, এটি এর বহিস্থ আস্তরণ ছুঁড়ে দিয়ে অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে যায়। একে বলা হয় সুপার নোভা। নক্ষত্রটি যখন সুপার নোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হয়, তখন এর কোর বা মূলবস্তুর চাপ এত বেশি হয় যে, প্রোটন ও ইলেকট্রন একত্রিত হয়ে নিউট্রন গঠন করে। একে তাই বলা হয় নিউট্রন স্টার বা নিউট্রন নক্ষত্র। নিউট্রন নক্ষত্রের সাথে জড়িত থাকে অতি উচ্চ চৌম্বকক্ষেত্র। এটি তাই একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর রেডিও পাল্স নির্গমন করে, একে তাই পালসার বলা হয়। ১৯৬৭ সালে প্রথম নিউট্রন নক্ষত্র বা পালসারকে উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছিল। 

(গ) নক্ষত্রের ভর যখন পাঁচ সৌর ভরের চেয়ে বেশি হয় :

   সুপার নোভা বিস্ফোরণের পর নক্ষত্রের ভর যদি খুব বেশি হয় তখন এর অন্তর্বস্তু অনির্দিষ্টভাবে সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে যে বস্তু তৈরি হয় তাকে কৃষ্ণবিবর বলে। কৃষ্ণবিবরের ঘনত্ব থাকে অত্যন্ত বেশি এবং এর পৃষ্ঠে অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর মান অত্যন্ত বেশি থাকে। প্রকৃতপক্ষে ৪ এর মান এত বেশি হয় যে, এমনকি ফোটন কণাও এর পৃষ্ঠ থেকে মুক্ত হতে বা বেরিয়ে আসতে পারে না। কোনো কণিকা বা ফোটন এর কাছে যেতে থাকলে, তাৎক্ষণিকভাবে এর মধ্যেই হারিয়ে যায়। এ কারণেই এরকম বস্তুকে বলা হয় কৃষ্ণবিবর। 

Content added || updated By